পঙ্গপালের আক্রমণ এবং বাংলাদেশ
পঙ্গপালের আক্রমণ এবং বাংলাদেশ
শুভ নববর্ষ বা হ্যাপি নিউ ইয়ার বলে ২০২০ সাল টা শুরু হলেও মোটেই ভাল যাচ্ছে না বছরটি। যুদ্ধ বিগ্রহের চাপাচাপি আগে থেকে থাকলেও এরপর আসে আমাজনে দাবানল, অস্ট্রেলিয়ায় বাঁদুড়। তারপর নতুনভাৱে চীনের উহান থেকে শুরু হলো নতুন ছোঁয়াচে রোগ করোনা যা অল্প দিনে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আসে আফ্রিকা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়া নতুন মহামারী পঙ্গপাল। দা হর্ন অফ আফ্রিকা নামে পরিচিত চৌদ্দটি এবং এশিয়ার ত্রিশটি দেশে যা ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন দেশ হয়ে পাকিস্তান ও সর্বশেষ আমাদের দেশের চারদিকে সীমানা বেষ্টিত ভারতে ব্যাপকভাবে আক্রমণ শুরু করেছে। তাই এখন করোনা সতর্কতার পাশাপাশি এই নতুন মহামারী নিয়ে চিন্তা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই আজকে এই পঙ্গপাল নিয়ে আলোচনা করবো।
পঙ্গপাল
পঙ্গপাল হল Acrididae পরিবারে ছোট শিংয়ের বিশেষ প্রজাতি যাদের জীবন চক্রে দল বা ঝাঁক বাধার পর্যায় থাকে। এই পতঙ্গগুলো সাধারণত একাই থাকে কিন্তু বিশেষ অবস্থায় তারা একত্রে জড়ো হয়। তখন তাদের আচরণ ও অভ্যাস পরিবর্তিত হয়ে সঙ্গলিপ্সু হয়ে পড়ে। পঙ্গপাল এবং ঘাস ফড়িংয়ের মধ্যে কোন পার্থক্যগত শ্রেণীভাগ নেই। বিশেষ অবস্থায় তাদের প্রজাতিরা একত্র হওয়ার যে প্রবণতা দেখায় সেটাই মূল পার্থক্য এবং এটাই আমাদের জন্য মহামারীর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
একা থাকা অবস্থায় এই ঘাস ফড়িংগুলো অনপকারী, তারা সংখ্যায় থাকে কম এবং কৃষির জন্য বিরাট কোন আর্থিক ক্ষতি করে না। তবে অনাবৃষ্টির পর দ্রুত ফসলের বর্ধন হলে এদের মস্তিষ্কে থাকা serotonin (সেরোটোনিন) হরমোন তাদের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তনের সূত্রপাত করে। ফলে তারা প্রচুর পরিমানে ও দ্রুত জন্মদান শুরু করে। তখন তারা একত্রে থাকে। যখন তাদের সংখ্যা বেশি হয় তখন তারা যাযাবর হয়ে পড়ে। এতে থাকে পাখাবিহীন ছোট পঙ্গপাল যেটা পরে পাখা জন্মে দলে যোগ দেয়। এই পাখাবিহীন এবং পাখনাসহ পঙ্গপালের দল একসাথে চলাচল করে এবং দ্রুত ফসলের মাঠের ক্ষতি করে। পূর্নবয়স্ক পঙ্গপাল শক্তিশালী এবং তারা অনেক দূর পর্যন্ত উড়তে পারে আর পথে যেখানেই থামে সেখান থেকে ফসল খেয়ে শক্তি অর্জন করে। একেকটি পোনপালের পঙ্গপালের দলে কয়েক কোটি পোকা পারে।
ইতিহাস
পঙ্গপালের এই ইতিহাস বহু পুরনো। পুরনো মিশরীয়রা তাদের কবরে এদের একেছিল। ইলিয়ড, বাইবেল এবং কোরান ইত্যাদি গ্রন্থে এর উল্লেখ আছে।বাইবেলে উল্লেখিত সবচেয়ে গুরুত্যপূর্ণ হলো "টেন প্লেগস অফ ইজিপ্ট"। প্রাচীন মিশরের ফারাওগণ বনি ইসরাইলদের মুক্তি না দেয়ায় সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে দশটি মহামারীর কথা কথা উল্লেখ আছে। তারমধ্যে পঙ্গপালের দল ফসল ধ্বংস করে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছে যার ফলে মানুষ প্রচরণশীল হয়েছে। তারমানে আমরা বুঝতেই পারছি আমরা নতুন কোনো ভীবিষিকা নিয়ে কথা বলছি না।
পঙ্গপালের কারণ
এই পঙ্গপাল টা অনেক পুরোনো হলেও হটাৎ আজকাল এতো বিভিষিকাময় হয়ে গেলো কোনো। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে এটা বিবর্তনের কারণে এমনটা হয়েছে। আবহওয়া পরিবর্তন ও সময়মতো যথাযত ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়ে দলবদ্ধ হয়ে বিপজ্জনক রূপ ধারণ করে ।
ক্ষতির ধরণ ও পরিমাণ
প্রথমে মনে হতে পারে একটাই তো পোকা কত র=আর খাবে ? একেকটা দলে প্রায় ৪০ মিলিয়ন পর্যন্ত পোকা থাকতে পারে। এক একটা দল একেক দিনে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের খাবার খেয়ে ফেলতে পারে। এক জায়গার খাবার শেষ হলে এরা অন্য জায়গায় উড়ে যেতে পারে এবং এরা একদিনে প্রায় ৯০ মাইল পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে।সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় এক জায়গা থেকে যাওয়ার সময় ওই জায়গায় আবার কোটি কোটি ডিম্ পেরে চলে যায় যা পরবর্তীতে আবার বংশবিস্তার করে। প্রতি বর্গমিটারে একহাজারটা পর্যন্ত ডিম্ তারা রেখে যেতে পারে। তাহলে যাচ্ছে আসলে এরা কত ভয়ঙ্কর। পাকিস্তানে এই পঙ্গপালের প্রাদুর্ভাবের ফলে সাঙ্গাতিক ক্ষতি হয়েছে। বেলুচিস্তান, সিন্দ প্রদেশ, পাঞ্জাবে বিপুল ক্ষতি হয়েছে অস্বাভাবিক খাদ্য ঘাটতি ডেকে দিয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের [প্রদেশের ২৬ টি জেলা , রাজেস্তান , গুজরাট ,দিল্লীসহ বেশ কয়েকটি প্রদেশ এই মহামারীর সম্মুখীন হয়েছে এবং এখন পশ্চিম বঙ্গের দিকে আসতেছে বলে জানানো হয় । তবে তাদের জন্য ভালো খবর হলো দুইটি ফসলের মাঝখানে এই পঙ্গপাল আক্রমণ করে যার ফলে ক্ষয়কত তুলনামূলকভাবে কম হয়।
পঙ্গপাল খাওয়া
পৃথিবীর অনেক দেশ এই পঙ্গপাল খেয়ে থাকে। তার মধ্যে সর্বভুক চীন প্রথম। তারপর আসে দুর্ভিক্ষ কবলিত দেশ ইয়মেন সহ অনেক দেশ। একটা হাদীস থেকে ও নবী (সা :) এর সময় পঙ্গপাল খাওয়া সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু বর্তমানে এই পঙ্গপাল খাওয়া উচিত হবে না কারণ এই পঙ্গপাল মারার জন্য বিভিন্ন কীটনাশক বাবহার করা হচ্ছে যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য কখনো ভালো হবে না। তাই ইউটিউব বা অন্য কোথাও থেকে দেখে খাওয়ার চিন্তা করা মোটেও উচিত হবে না।
জাতিসংঘের সতর্ক হবার আহ্বান
এ মাসের দশ তারিখে জাতিসংঘের ফাও একটি নির্দেশনা জারি করে, যাতে আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার কয়েকটি কৃষি প্রধান দেশকে সতর্ক হবার আহ্বান জানানো হয়েছে।ঐ নির্দেশনায় বলা হয় 'হর্ন অব আফ্রিকা' অর্থাৎ পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ায় বছর খানেক ধরে পঙ্গপালের ব্যাপক বংশবিস্তার হয়।উগান্ডা, তাঞ্জানিয়া, সৌদি আরব, ইরিত্রিয়া এবং ইয়েমেনসহ কয়েকটি দেশে পঙ্গপাল হামলা চালাতে পারে বলে সাবধান করা হয়।
কৃষক কীভাবে সাবধান থাকবেন
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক মি. জাহান বলেছেন, পঙ্গপালের উপদ্রব ঠেকাতে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকরী পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি।"এরা বাতাসের সঙ্গে উড়ে আসে, আকাশ পথে উড়ে আসা কোন আক্রমণ থেকে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি রক্ষার কোন উপায় এখনো আমরা জানি না। তাছাড়া এরা কোন অঞ্চল লক্ষ্য করে যাত্রা শুরু করার পর সেটা থামিয়ে দেবার কোন পদ্ধতির কথাও আমরা জানি না।"তবে, পঙ্গপালের হাত থেকে বাঁচার জন্য বেশিরভাগ সময় উড়োজাহাজে, বা বহনযোগ্য যন্ত্রের সাহায্যে কীটনাশক ছিটিয়ে এদের দমন করা হয়।যদিও মি. জাহান বলছেন, সমস্যা হল এতে উপকারী কীটপতঙ্গও মারা পড়ে, যে কারণে এটি জটিল একটি সিদ্ধান্ত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন